সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বান্ধব নাট্যের ইতিহাস । চারুচন্দ্র সান্যাল

 


বান্ধব নাট্যের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে

বান্ধব নাট্যের ইতিহাস

শ্রীচারুচন্দ্র সান্যাল

 

  জনসেবা নিয়ে গড়ে উঠেছিল বান্ধব মিলন সমিতি ও পরে হয়ে উঠলো বান্ধব নাট্য সমাজ। আজও জনসেবার মনোভাবটি জেগে আছে সভ্যদের ভেতরে। ১৯২০ সনের আগে থেকে জলপাইগুড়ি সহরে ছিল ভয়াবহ ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া প্রভৃতি। এর সাথে ছিল এক রকমের জ্বর। হুহু করে জ্বর এল, কালির মতো কালো প্রস্রাব হল। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে এপারে না হয় ওপারে। হাসপাতাল ছিল খুবই ছোট, নার্স ছিল না। অনেক বাড়িতে শুশ্রূষার লোকও ছিল না। বেডপ্যান, ইউরিনাল, গরম ও ঠাণ্ডা বরফের ব্যাগ, এমন কি থার্মমিটারও অনেক বাড়িতে ছিল না। অথচ এ সবের খুবই দরকার ছিল। এই অবস্থা দেখে রাজেন্দ্র কুমার নিয়োগী, মহেশচন্দ্র চক্রবর্তী, মোহিনী মোহন ভৌমিক (বুধুবাবু), প্রিয়নাথ গোস্বামী, সত্যভূষণ রায় (ননীবাবু), মধুসুদন দাশগুপ্ত, শ্রীচারুচন্দ্র সান্যাল, শ্রীভবরঞ্জন গাঙ্গুলী প্রভৃতি মিলে ১৯২২ সনে এক সেবা সমিতি গড়ে তোলেন ও চাঁদা সংগ্রহ করে উপরোক্ত কিছু কিছু সরঞ্জাম কিনে রাখলেন। অনেক যুবক এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন। দলে দলে ভাগ হয়ে হাসপাতালে ও গৃহে গৃহে সেবা শুশ্রূষা করতেন। দাহ করার লোক না থাকলে সব জাতের মৃতদেহ দাহ করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরে দেহের কোন জাতি থাকে না। পড়ল ইংরেজ সরকারের অশুভ দৃষ্টি। ১৯২৪ সনে সমিতিটি ভেঙ্গে দেওয়া হল। সরঞ্জামগুলি কিছু নষ্ট হল, যেগুলি রোগীদের বাড়িতে ছিল তা আর ফিরলো না।

  ১৯২৪ সনে নতুন ভাবে আর একটি সেবা সমিতি গড়ে উঠলো একই কর্মধারা নিয়ে। এতে থাকলেন শ্রীকালিপদ মৈত্র, (তখন পুলিশ কর্মচারী) জননী রায়, মধু দাশগুপ্ত, ডি, আই, জি অপিসের সুরেন ধর প্রভৃতি। এঁরাও চাঁদা তুলে সাজসরঞ্জাম কিছু কিনলেন রোগীর সেবার জন্য। এঁদের কাজ স্বভাবতঃই সীমিত হতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর সাথে ব্যয় বাড়লো। তখন স্থির করলেন অভিনয় করে ও এই বাবদ টিকিট বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করবেন। স্থানীয় আর্য্যনাট্য সমাজে তখন একমাত্র অভিনয়ের স্টেজ।

  সমাজের সাথে ব্যবস্থা হল ওখানে দুই রাত অভিনয় হবে। প্রথম রাতে অভিনয় হল 'দেবলা দেবী'। খুব টিকিট বিক্রি হল। দ্বিতীয় রাতে কোন অজ্ঞাত কারণে সমাজের পরিচালক দল ষ্টেজ দিতে চাইলেন না, দিলেনই না। মনোমালিন্য শুরু হল। শেষ দিকে অন্যতম ট্রাস্টি তারিণী প্রসাদ রায় মহাশয়ের মধ্যস্ততায় আবার দুই রাত্রি আর্য্যনাট্য সমাজ গৃহে অভিনয়ের ব্যবস্থা হল। এবার প্রথম রাতে 'দুর্গাদাস' অভিনীত হল। খুব টিকিট বিক্রি হল। আবার দ্বিতীয় রাতে ষ্টেজ পাওয়া গেল না। অভিনয় হলো না। মনোমালিন্য বাড়লো, জেদ চেপে গেল।


জলপাইগুড়ি লেখকদের বই সারা দেশে হোম ডেলিভারি

পুস্তক তালিকা ডাউনলোড করুন



  এইবার সেবা সমিতিটি বান্ধব নাট্য সমাজরূপে আত্মপ্রকাশ করলো। গণেশচন্দ্র সান্যাল ছিলেন সৌখিন লোক। প্রতি বছর পরিবারের অনেকে ও বন্ধুবান্ধব যথা শ্রীকালিপদ মৈত্র, শ্রীব্রহ্মগোপাল ব্যানার্জি, মনোরঞ্জন দাশগুপ্ত, নলিনীকান্ত রাহুত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি মিলে অভিনয় করতেন। একটি পূর্ণাঙ্গ স্টেজ ছিল বাড়িতে। বান্ধব নাটা সমাজে যোগ দিলেন উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশচন্দ সান্যাল, সুরেন ধর, লোকে বাগচী প্রভৃতি। সান্যাল বাড়ির স্টেজ দিয়ে কদমতলা পাটগুদামের একটি গৃহে অভিনয় সুরু হল। জমির চেষ্টা চলতে লাগলো। বাকালীর অব্দুল করিম প্রধান সাহেব তাঁর শহরের বাকালী হাউসের পশ্চিম দিকে যে সুপারী বাগান ছিল পাহাড়ীপাড়া রাস্তা পর্যান্ত সেই সব জমি দিতে রাজী হলেন নাট্য সমাজের গৃহ নির্মাণের জন্য। পরে কোন কারণে সে জমি পাওয়া গেল না। পাট-গুদামেই অভিনয় চলতে থাকলো। 

  এখন নবাব ষ্টেটের ম্যানেজার, আসরাফ উদ্দিন চৌধুরী ও আব্দুল সোভান সমিতিতে যোগ দিলেন। এবার শ্রীযুক্তা মাঞ্জনেছা খাতুনের কাছ থেকে বার্ষিক দুইশত টাকা খাজনায় বর্তমান জমিটি পত্তা হওয়া গেল। এটি হল ১৯২৪ সনের প্রায় শেষ দিকে।

  অর্থ ও গৃহ নির্মাণের মালপত্তর সংগ্রহ শুরু হল। বাতাবাড়ির একজন জোতদার দিলেন খুটি, ডুয়ার্স থেকে সংগ্রহ হল কাঠের তক্তা। এখন যোগ দিলেন নলিনী চৌধুরী, মখলেছার রহমান, বিষ্ণুপ্রসাদ মিশ্র প্রভৃতি। লোকেন বাগচী খুব কম দামে টিন সংগ্রহ করে দিলেন। প্রসন্নদেব রায়কত ও নবাব মুশারফ হোসেন এখন যোগ দিলেন। সবার সমবেত চেষ্টায় চা কোম্পানীগুলি থেকে প্রচুর টাকা সংগ্রহ হল।

  বান্ধব নাট্য সমাজের বর্তমান গৃহটি তৈরী শেষ হল ১৯২৬ সনে। সাঙ্গাল বাড়ির সিন দিয়েই প্রথম অভিনয় সুরু হল। স্থানীয় পুলিশ লাইনের হরিপদ বাবু অনেকগুলি সিন নিজে এঁকে দিলেন। তিনি ছিলেন উঁচু দরের চিত্রশিল্পী। ধীরে ধীরে নতুন সিন ও সুন্দর স্টেজ তৈরী হল। অভিনয়গুলি খুবই জনপ্রিয় হতে লাগলো।

  ১৯২৬ সনে বান্ধব নাট্য সমাজের আইন-কানুন তৈরী হল। এই সময়ে প্রথম ট্রাস্টি বোর্ড গঠন হল। এতে থাকলেন প্রসন্নদেব রায়কত, নবাব মুশারফ হোসেন, নগেন্দ্রনাথ মহালানবীশ, কালিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশচন্দ্র সান্যাল ও লোকেন্দ্রনাথ বাগচী। ১৯২৯ সনে নতুন ট্রাষ্টি বোর্ড গঠন হল। এতে থাকলেন প্রসন্নদেব রায়কত, নবাব মুশারফ হোসেন, মখলেছার রহমান, নগেন্দ্রনাথ মহালানবীশ, বিষ্ণুপ্রসাদ মিস্তা ও শ্রী চারুচন্দ্র সান্যাল। নতুন পরিচালক সমিতি গঠিত হল। সভাপতিঃ মখলেছার রহমান, সহ সভাপতিঃ শ্রীচারুচন্দ্র সান্যাল, সম্পাদকঃ বিষ্ণুপ্রসাদ মিশ্র।

  বিষ্ণুবাবুর পরে সম্পাদক হন যথাক্রমে উমাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকালিপদ মৈত্র এবং এনামুল হোসেন। ধীরে ধীরে সমাজের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগলো। আর্যনাট্য সমাজ থেকে সতীশ মাষ্টার এখানে যোগ দেবার পর নাচের দিকটা খুবই উন্নত হল। কিন্তু আয়ের সাথে ব্যায়ের সমতা রাখা গেল না। তাই ব্যায় সঙ্কুলানের জন্য বাধ্য হয়ে সিনেমা চালাবার জন্য স্পেন্সার সাহেবকে হলটি ভাড়া দেওয়া হল। কিছুদিন পরে স্পেন্সার টকিজ উঠে গেলে শ্রীনগেন গাঙ্গুলী মহাশয়কে কতগুলি সর্তে সিনেমার জন্মা হলটি ভাড়া দেওয়া হল। ১৯৫২ সন পর্যান্ত গাঙ্গুলী মশাই বান্ধর নাট্য সমাজ হলে সিনেমা চালান। পরে ১৯৫৬ সনে দীপ্তি সিনেমাকে হলটি ভাড়া দেওয়া হল। এখনও চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে মাঝে মাঝে হলটি ভাড়া দিয়ে অর্থাগম হতে লাগলো। সভ্য সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।

  প্রতিকূলের সাথে লড়াইতে আছে উত্তেজনা, আসে উৎসাহ। নানা ঝড়ঝাপটার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো এই সমাজ। বহু যুবক এখানে এসে জুটলেন। এখন সভাপতি শ্রীচারুচন্দ্র সান্যাল, সম্পাদক শ্রীএনামুল হোসেন। কেন্দ্রীভূত পরিচালনা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হল বিদ্রোহ।

  আদর্শের সংঘাত এতে ছিল না। একদল মনে করলেন প্রচলিত পরিচালন ব্যবস্থায় সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সনে চললো লড়াই পুরাতনের সাথে নতুনের। ১৯৬৮ সনের বন্যার পরে সব লড়াই ভেসে গেল। সবাই এসে জুটলেন সমাজটাকে ভাল করে তৈরী করতে। সবাই মিলে সভা করলেন। পুরণো আইনকানুনের কিছু রদবদল করে সব সভ্যের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। পরিচালক সমিতি গঠিত হল। নতুন পেট্রন হলেন শ্রীবীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, সভাপতি  শ্রীচাকচন্দ্র সান্যাল, সহঃ সভাপতি শ্রীসত্য সান্যাল, সম্পাদক শ্রীরবি বাগচী।

  এক বছর পরে অধিকাংশ সভ্যের অনুরোধে শ্রীসত্য সাম্মাল সম্পাদক হলেন ও এখনও আছেন। পুরণো সমাজ গৃহের পাশে সুন্দর আর একটি গৃহ তৈরী হচ্ছে। সেখানে ছোট সভা, উৎসব প্রভৃতি করা সম্ভব হবে। এতেও কিছু অর্থাগম হরে।

সাধারণের ধারণা আমাদের যুব সমাজ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্র ও সুযোগ পেলে তারা বুড়োদের সাথে নিলেও অসাধ্যসাধন করতে পারে তার পরিচয় আজকের বাস্তব নাটা সমাজ ও অতি উন্নত শ্রেণীর অভিনয়।

  স্মৃতিচারণে অনেক কথা বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছে। ১৯৬৮-এর বন্ধ্যায় পুরণো কাগজ-পত্তর নষ্ট হয়ে গেছে। হয় তো অনেক কথা বলা হয় নি, অনেক নাম বাদ পড়ে গেছে। তবে শ্রীকালিপদ মৈত্র মহাশয় অনেক কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে জানাই কৃতজ্ঞতা।

 

চারুচন্দ্র সান্যালের এই লেখাটি বান্ধব নাট্যের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে তা দুর্লভ হওয়ার কারণে পুণর্মূদ্রিত হলো


হোম




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পুস্তক তালিকা

পুস্তক তালিকা তালিকায় প্রদত্ত বইগুলির দামের পরিবর্তন হতে পারে। স্টক থাকার ওপর সরবরাহ নির্ভর করছে। তবে আমরা বই সময় মত সরবরাহ করার ব্যাপারে আন্তরিক ডাউনলোড সংক্ষিপ্ত পুস্তক তালিকা বিস্তারিত পুস্তক তালিকা দুটি খন্ড প্রকাশিত ডাউনলোড ২য় খন্ড ডাউনলোড ১ম খন্ড

নির্জনে রূপসারী। লেখকঃ শুভ্র চট্টোপাধ্যায়

   সান্ধ্য জলপাইগুড়ি পিডিএফ প্রকাশনী নির্জনে রূপসারী মূল্য ৩০.০০   নমুনা ডাউনলোড করুন কিনতে চাইলে প্রদত্ত ইউপিআই-তে টাকা পাঠান   UPI ID: scajpg@okicici পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পড়ুন নির্জনে রূপসারী উপন্যাস লেখকঃ শুভ্র চট্টোপাধ্যায় গোত্রঃ রোমান্স মূল্যঃ ৩০.০০ টাকা   বইটি সম্পর্কে   নির্জন একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েট। তাঁর বাবা একজন আমলা। কিন্তু তাঁকে সরকার কাজ দিতে আগ্রহী নয়। নির্জন ঠিক করেছে যে সে একটা চায়ের দোকান দেবে। ঠাকুর্দার কবিরাজি-চেম্বারটা পড়ে আছে। সেখানেই দোকান চালু করবে সে। নির্জনের বান্ধবী রূপসারী থাকে ময়নাগুড়িতে। সে লেখাপড়ায় ভালো। নির্জনের সাথে তাঁর সম্পর্কের ধরনটা ঠিক বোঝা যায় নয়া। চায়ের দোকানের উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর গল্পে চলে এলো স্থানীয় কাউন্সিলর টুনিদি এবং এক বৈজ্ঞানিক। তিনিও শহরের লোক তবে জার্মানিতে থাকেন। নির্জনের চায়ের দোকানের উদ্যোগের সাথে এরাও জড়িয়ে গেলেন। ওদিকে নির্জনের বাবা সুশোভন নন্দী বদলি হয়ে এসেছেন কালিম্পং-এ। তাঁর সাথে আলাপ জমেছে একজন বয়স্ক লোকের। কিন্তু নির্জনের চায়ের দোকান উদ্বোধনে প্রশাসন এত সিরিয়াস হয়ে গেল কেন? মাঝখানে তবে কে এলো? দোকা...